ভাষা আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে সেরকম কোন প্রামাণিক দলিল নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে, পুরানো কাগজে লুকিয়ে আছে এই তথ্যগুলো। কিন্তু দেশরক্ষার তাগিদে নারীদের আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ভুমিকা এইভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে তার অবমাননাই করা হয়। সেই তাড়না থেকেই লেখক সুপা সাদিয়া বের করছেন “বায়ান্নর ৫২ নারী” এবং “ ৭১র নারী”। বইদুটি কথাপ্রকাশ প্রকাশনীতে পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৪ সালে বইমেলায় সব কপি নিঃশেষ হবার পর এইবার এসেছে দ্বিতীয় সংস্করণ। সুপা সাদিয়া বর্তমানে রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। ভাষার জন্য নারীদের আন্দোলনকে বইয়ের ভাঁজে তুলে আনার গল্পের পাশাপাশি সুপা সাদিয়ার সঙ্গে ফেমিনিজমবাংলার আড্ডায় উঠে এলো তাঁর অনেক দর্শনের গল্পও।

‘বায়ান্ন র ৫২ নারী’ এবং ‘৭১র নারী’ বই দুটি লেখার অনুপ্রেরণা

আমার বাবা এবং মামা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে অনেক কাজ করেছেন। আসলে সব জায়গায় নারী মুক্তিযোদ্ধা বলতে বোঝায় বীরাঙ্গনা। মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধাই, তাঁকে বোঝানোর জন্য বীরাঙ্গনার প্রয়োজন নেই। তো এইসব তাড়না থেকে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। জানতে পারি, ভাসা আন্দোলনে কি বিপুল পরিমাণ ছাত্রী অংশগ্রহণ করেছিল সেইসময়ে। ৫২র নারী বইটিতে ৫২ জন নারীকে নিয়ে লিখি। লেখার পরে তুমুল সাড়া পাই। তারপরেই ৭১ র নারী বইটি লিখি।

‘বীরাঙ্গনা’ উপাধির প্রয়োজন নেই বলছেন

এই উপাধির আসলেই দরকার নেই। মুক্তিযোদ্ধাই বড় কথা। সে যুদ্ধ করেছে।

বইয়ের কাজ করতে কতটা সময় লেগেছে?

৩ বছর লেগেছে। ২০১১ থেকে শুরু করে ২০১৪ পর্যন্ত কাজ করেছি। ২০১৪ র বইমেলায় প্রকাশিত হয় এই গ্রন্থ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, বই, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রায় ৩১ জনের তথ্য সংগ্রহ করেছি। ৭১ র নারীর বইতে ৭১ জন নারীর কথা এসেছে। বিশেষভাবে এসেছে ইন্দিরা গান্ধীর কথা।

supa 4

আপনার পড়াশুনা তো ইতিহাসে না?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএম কলেজ থেকে গণিতে অনার্স মাস্টার্স।

গনিতের ছাত্রী হয়ে

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পাবলিক রিলেশনে জব?

আমার ছোটবেলা কেটেছেই উদীচীতেই। এধারার কাজ করতেই আমি আগ্রহি ছিলাম বেশী,। ১৯৯৯ সালে যখন উদীচীতে বোমা হামলা হয়, আমি সেদিন ছিলাম না ভাগ্যের জোরে। আগের দিন বরিশালে চলে আসি। না হলে আমিও বাঁচতাম না।

বইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে কতটা কষ্টসাধ্য ছিল?

ফুলটাইম জবের পর সন্ধ্যায় এই কাজগুলো করতাম। মানুষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা ছিল ভীষণ কষ্টের। বাবা নিজেও এই ধরণের কাজ আগে করেছিলেন বলে অনেক পুরনো তথ্য বাবার কাছ থেকেও পাই।

একটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রজন্মে

আমাদের প্রজন্মে থেকেই এটা শুরু হয়েছে। মূল জায়গা হচ্ছে মোটিভেশন, সুক্ষ মোটিভেশন করতে ব্যর্থ হয়েছি এই প্রজন্মের কাছে। ভয়েস রাইস হচ্ছে না তেমন।

এই যে আস্তিক নাস্তিক ইস্যু…

যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকেই কিন্তু এমন এমন কথা বলা হচ্ছে যেখান থেকেই মূলত এই ইস্যুগুলো সৃষ্টি করা হচ্ছে। ধর্মটা এখন একটা রাজনৈতিক ইস্যু। আমি বহু মানুষকে দেখেছি, উদীচী করছে, গণজাগরণ করছে, খুব নামাজি কিংবা তাবলীগও করছে তারা। ধর্মের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া কোন কনফ্লিক্ট আসলে নেই।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার তো হচ্ছে!

একদিকে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে, অন্যদিকে ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানুষ তৈরি হচ্ছে। বেশী বেশী প্রচারণা দরকার। অলরেডি দুটো জেনারেশন নষ্ট হয়ে গেছে। এই জেনারেশনের ভেতর সত্য জাগাতে অনেক মোটিভেশন দরকার। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে জোরাল প্রচারণা দরকার।

supa 2

মুক্তিযোদ্ধাদের মানবেতর জীবন

যারা যুদ্ধ করছেন তাদের কাছে সম্মানটাই বড়, তাঁদের প্রত্যাশা সরকার এবং সাধারণ মানুষ তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াক।

সরকার কি পেরেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সম্মান দিতে?

আসলে সব সরকারই নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত। জনসাধারণের ক্যাটাগরিতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এখানে বিসিএস ক্যাডার প্রথম সারির নাগরিক। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম সারির নাগরিক না।

বই নিয়ে পরিকল্পনা?

ভবিষ্যতে বই নিয়ে প্রচুর কাজ করার চিন্তা আছে। আরও তথ্য সংগ্রহ করছি।

ফ্যামিলি কেমন সাপোর্ট করে এইসব কাজে?

ছোটবেলা থেকে আমাকে কখনও ছেলে মেয়ে আলাদা করে মানুষ করা হয় নি। আমি মানুষ হিসেবে বড় হয়েছি। আমার পরিবার, আমার দাদার পরিবার ভীষণ প্রগতিশীল ছিল। বাবা এ ধরণের কাজ করেছে এবং আমাকেও উৎসাহ দিয়েছে। বিয়ের পর পেয়েছি স্বামীর কাছে উৎসাহ। রায় ১১ টা ১২ টা বেজে যেত কাজ করতে করতে। স্বামী নিজেই চা বানিয়ে দিত, রান্না করত। অনেক সাহায্য করেছে আমাকে।

supa 5

 

নারী মুক্তি কি এসেছে?

একদমই না। পরিবারগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। একটা কথা কি, পুরুষরা নারিমুক্তি নিয়ে প্রগতিশীল কথা বলে, কিন্তু জায়গা ছেড়ে দিতে পারে না। বাইরে নারীমুক্তি নিয়ে বড় বড় বুলি বলা লোকেরা নিজেদের বউ বা মেয়েকে সাপোর্ট দিতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়ে হওয়া মানেই ঘর সংসার করা, রান্নাবান্না করা। নারীদের বড় বড় ভুমিকায় আসা উচিত।

নারী মুক্তিযোদ্ধারা আজকের দিনে নারীদের জন্য কতটুকু প্রেরণা হতে পারে?

ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ না, একটা মেয়ে আসলে কি পারে না? সব পারে। দেশের জন্য নিজের জীবন, সতীত্ব দেওয়া নারী মুক্তিযোদ্ধারা অনেকাংশে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতেও বড়। তাঁদের বিশাল বিশাল স্যাক্রিফাইসের কারনেই আজকে আমাদের এই দেশ।